অনুবাদকের কৈফিয়ত

 

গান শেষ হলে শিল্পীর স্তব্ধ হবার পালা। শ্রোতা তালি দেবেন না দুয়ো সেটা তাদের অভিপ্রায়। শিল্পী তার চেষ্টার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন সুরের জাদু তৈরিতে। শ্রোতা-দর্শকের রায়ই তাকে শেষমেষ নতমস্তকে মেনে নিতে হয়। অনুবাদকর্ম ব্যাপারটিও এরকম একটি শিল্প। এ যেন ভিনদেশী মাটির ফুলকে দেশের মাটিতে ফলানোর, তার রঙ আর সৌরভকে ছড়িয়ে দেবার এক আপ্রাণ চেষ্টা।

ইয়োভাল নোয়াহ হারারির সাথে আমাদের পরিচয় Coursera নামের ওয়েবসাইটে নেয়া একটা অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে। মানুষের ইতিহাস বিষয়ের কোর্স। আগ্রহের বিষয়। কিন্তু ভয় ছিলো কোর্সটা আবার কেবল দিন, ক্ষণ আর রাজা-গজার হার-জিতের কচকচানি হয়ে না যায়। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, লোকটার আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার, হালের তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির যথেষ্ট খবর রাখেন এবং ইতিহাসের তথ্য-উপাত্তকে কী করে ভবিষ্যৎ জীবনে প্রয়োগের উপযোগী সিদ্ধান্তে পরিণত করা যায়, সচেতনভাবে সে চেষ্টা করেন।

আমরা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ভিডিও লেকচারগুলো অনুবাদ করে ফেলবো। লেকচার অনুবাদের কাজ শুরু করতে না করতেই জানা গেলো হারারি এ সংক্রান্ত একটি বই ইংরেজীতে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। নাম Sapiens: A Brief History of Humankind। এরপর বইয়ের জন্য অপেক্ষা। যুক্তরাজ্যে বইটা প্রথম মুক্ত হলো। আমরা কয়েকজন বইটা আনালাম। বইটা পড়ে আমাদের এটুকু ধারণা হলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই বইটার অনুবাদ পৌঁছালে তারা প্রচলিত অনেক ধ্যান-ধারণাকে নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখতে শিখবেন। বইটার অনুবাদ শুরু হলো। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল সহজবোধ্য এবং মূলানুগ একটি অনুবাদ করা যেটা পড়তে মানুষ আনন্দ পাবে এবং স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও সহজেই বুঝতে পারবে। কাজটা শুরু করে বোঝা গেলো কাজটা সহজ তো নয়ই, রীতিমতো দুঃসাহসিক ব্যাপার আমাদের জন্য। নিজেরা কম্পিউটার প্রকৌশলের সাথে যুক্ত থাকায় প্রযুক্তি বিষয়ক অংশগুলো বোঝা এবং অনুবাদ করা মোটামুটি সহজ ছিলো। বাকি অংশের জন্য পড়া শুরু হলো। Jared Diamond এর Guns, Germs, and Steel, বাংলা পরিভাষার জন্য নূরুন নাহার বেগম ও আবদুল হালিমের তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘মানুষের ইতিহাস’, প্রাঞ্জলতার নমুনার জন্য দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এর ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ সহ বাংলায় ও ইংরেজিতে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বেশ কিছু বই পড়ার পর সাহস বাড়ল। কাজে গতি ফিরলো।

অনুবাদের শুরু থেকেই আমাদের চেষ্টা ছিল অনুবাদস্বত্ব পাবার। কিন্তু, মাঠে নেমে দেখা গেলো এই কাজটিও মোটেই সহজ নয়। লেখক, প্রকাশক, উপমহাদেশীয় এজেন্ট – কোনকিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু বাদ সাধে দেশ ও বিদেশের সেতুবন্ধনে। দেশীয় প্রকাশনীর পেশাগত সীমাবদ্ধতা যেমন এর কারণ, তেমনি অর্থনৈতিক ব্যয়ের প্রসঙ্গটাও এড়িয়ে যাবার মতো না। এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের দৈন্যদশাটা আরও প্রকটভাবে চোখে পড়ে। সে নিয়ে আলাদা একটা অধ্যায় লেখা যাবে হয়তো।

যাই হোক, একজন প্রথিতযশা প্রকাশক বইটি প্রকাশে উৎসাহী হলেন এবং অনুমতির জন্য যোগাযোগ করতে চাইলেন। ব্যক্তিগত ই-মেইল থেকে যোগাযোগ। উত্তর নেই। আমরা এবার মরিয়া হয়ে অনুবাদক হিসেবে অনুমতির চেষ্টা করতে থাকি। লেখককে মেইল করি। লেখক থেকে এজেন্ট, এজেন্ট থেকে প্রকাশক। প্রকাশকের আবারও সেই কথা। বাংলাদেশের প্রকাশককে যোগাযোগ করতে বলুন। এর মধ্যে দুই বছর পেরিয়ে গেছে। আমাদের অনুবাদ শেষ করে আমরা তিন দফা সম্পাদনা করেছি গুণগত মান উন্নয়নের জন্য। অনেকেই নানা পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের। কিন্তু অনুমতিজনিত সমস্যার কারণে প্রকাশে একটা খচখচানি থেকেই যাচ্ছিল মনের মধ্যে। প্রকাশকও অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে আর কোনরকম চেষ্টা করতে উৎসাহী হলেন না।

এর মাঝে ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় অন্তত দুটি অনুবাদকে আমরা প্রকাশিত হতে দেখলাম। কেউ অনুবাদ হিসেবেই প্রকাশ করেছেন। কেউ একটু সম্পাদনা করে, তথ্য সংক্ষেপন করে মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে। আমরা এই বইটি থেকেই জানি, কপিরাইট, রীতি-নীতি এসব মানুষের সামষ্টিক কল্পনা মাত্র এবং এসবের জন্ম মানুষের কল্যাণে। আমাদের মনে হয়েছে, এই বইটি বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব জরুরি। সেই ধারণা থেকেই আমাদের এতদিনের এই চেষ্টা এবং তারই ফসল এই অনুবাদ। আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল এই অনুবাদটিকে দুই মলাটের মাঝে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার। বলা বাহুল্য সেটা আমরা করতে চেয়েছিলাম যথাযথ গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষণ করেই। কিন্তু নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হলো না। এই আক্ষেপ রইলো আমাদের মনে। প্রায় তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সীমাহীন রোমাঞ্চকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরার জন্যেই অন্তর্জালভিত্তিক আমাদের এই প্রয়াস। কোন দেশীয় প্রকাশনী যদি গ্রন্থস্বত্বসহ অনুবাদটি বাংলাদেশের পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারে তাদের জন্য আমাদের অশেষ শুভকামনা।

এখন শিল্পীর কাজ শেষ। বাকিটা পাঠকের বিবেচনা। আপনারা বইটির মানোন্নয়নে যে কোন পরামর্শ দিলে উপকৃত হবো। বইটি ভালো লাগলে আপনারা অন্যদেরকে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য যে কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে পারেন।

অনুবাদক

মোস্তাক আহমেদ

ইউএক্স আর্টিস্ট

শুভ্র সরকার

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

সুফিয়ান লতিফ

গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট

রাগিব আহসান

গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট